মহাকাশ স্টেশন কি?

মহাকাশ স্টেশন কি
মহাকাশ স্টেশন 


মানব জাতি বরাবরই অজানাকে জানার আগ্রহ অদম্য । আর এই অজানার পথে পাড়ি জমাতে মানুষ তৈরি করেছে নানা ধরনের যানবাহন । বিভিন্ন ধরনের জলোযানে চেপে মানুষ প্রথমবারের মতো নিজেদের বাসস্থানের পৃথিবী কে আবিষ্কার করেন । এরপর উড়োজাহাজ তৈরীর মাধ্যমে মানুষ পূরণ করেছে তার আজন্ম উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন । অবশেষে একসময় মানুষ পৃথিবীর গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে যায় মহাকাশে । আর বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নিয়মিত ভাবে মানুষ বসবাস করছে ।

মহাকাশ স্টেশন

আজকে জানবো পৃথিবীর বাইরে মনুষ্য নির্মিত সবচেয়ে বড় স্থাপনা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন সম্পর্কে । প্রতিটি যুগে মানব জাতির সবচেয়ে চৌকস ও সাহসী সন্তানেরা পাড়ি জমিয়েছে আবিষ্কারের নেশায় । ঠিক একইভাবে পৃথিবীর গণ্ডি পেরিয়ে মহাশূন্যের বিপদসংকুল যাত্রা করতে দরকার হয়েছে মানব সভ্যতার সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি । বিজ্ঞান কে কাজে লাগিয়ে মানুষ মহাশূণে গড়ে তুলেছে এক অভূতপূর্ব ঘাঁটি । আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন হল এক বিশেষ ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহ । যেখানে মানুষ বসবাস করতে পারে এটি ওজন বিহীন পৃথিবী । যেখানে মধ্যাকর্ষণ বল এতটাই হালকা যে শুধু ছোট খাটো বস্তু নয় মানুষ সহ এখানে থাকা সকল উপাদান এই সব সময় ভেসে বেড়ায় ।

এখানে উপর-নিচ বলে কিছু নেই তাছাড়া নেই কোন দিন রাতের হিসেব । মনুষ্য নির্মিত বিজ্ঞানের এই দুর্গ অনবরত ছুটে চলেছে মহাকাশের অজানা অন্ধকারকে দূর করে । আর এই অসামান্য অবকাঠামো তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল এমন এক সময়ে যখনকার কম্পিউটার গুলো ছিল আমাদের স্মার্টফোনের চেয়েও কম ক্ষমতা সম্পন্ন । ১৮৬৯ সালে এভরট হেল প্রথম মহাকাশ স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা করেন । এরপর বিংশ শতকের প্রথম দিকে কনস্টান্টি তিশোলকোভস্কি ও হারমান ওবেথ এর র্ম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারনা যোগ করেন । 

মহাকাশ স্টেশনের নামকরন

১৯২৯ সালে হার্মান পোটনিক তার দা প্রবলেম অফ দিস্ট্রেস ট্রাভেল বইতে সম্ভাব্য মহাকাশ স্টেশন এর নকশা প্রণয়ন করেন । এরপর আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে বা আই এস এসে কল্পনা থেকে বাস্তবে রূপান্তর করতে বহু সময় লেগেছে । ১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র একটি মহাকাশ প্রকল্প হাতে নেয় এর নাম দেওয়া হয় স্পেস স্টেশন ফ্রিডম । কিন্তু এটি এর মূল পরিকল্পনা নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি । পরবর্তীতে অন্যান্য কয়েকটি দেশ এখানে তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করে । করার পর ১৯৯৩ সালে এর নাম দেওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন ।

স্টেশন তৈরিতে যে রকেটগুলো ব্যবহার করেছিল

এরপর নানা ধাপে বহু চ্যালেঞ্জিং নির্মাণযগো সম্পন্ন করে আই এস এসে আজকের পর্যায়ে আসতে পেরেছে । এরপরও স্টেশন নিয়ত পরিবর্তনশীল । আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন মহাশূন্যে মনুষ্যনির্মিত সবচেয়ে বড় স্থাপনা । পৃথিবীতে বিভিন্ন খন্ডে স্টেশন নির্মাণ করে মহাকাশে নিয়ে এগুলোকে জোড়া দেওয়া হয়েছে । মহাকাশ স্টেশনের এক একটি খণ্ড বা মডিউল তৈরি করা হয়েছে এশিয়া ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার একাধিক দেশের সহায়তায় । মডিউল গুলোকে পৃথিবী থেকে মহাকাশের নির্মাণ স্থলে পৌঁছানোর কাজে ব্যবহার করা হয়েছে তিন ধরনের রকেট । 

রকেটগুলো আমেরিকান স্পেস শাটল, রাশিয়ান পোটন রকেট ও রাশিয়ান সূয়ুস রকেট । এই রকেট আবিষ্কার না হলে মহাকাশ স্টেশন কখনোই নির্মাণ করা সম্ভব হতোনা । রকেট গুলো ব্যবহার করে মহাশূন্যে ভাসমান এই মানব দুর্গ নির্মাণ করতে ১৩ বছরেরও বেশি সময় লেগেছে । এই স্টেশন নির্মাণের শুরুটা হয়েছিল আমেরিকা ও রাশিয়ান দুটিস্টেশন কে মহাকাশে সংযুক্ত করার মাধ্যমে । দুটি দেশের মহাকাশ যান নির্মাণের প্রযুক্তির ভিন্নতার কারণে দুটি স্টেশনকে সহজে সংযুক্ত করা যাচ্ছিল না । 

কনভাটার প্রেসারাইজড মেটিং সংক্ষেপে (PMA)

পরবর্তীতে এই দুটি ভিন্ন প্রযুক্তির মহাকাশ কামরাকে একত্রিত করতে নির্মাণ করা হয় এক বিশেষ ধরনের কনভাটার ।যার নাম হল প্রেসারাইজড মেটিং এডাপ্টার সংক্ষেপে বলা হয় পি এম এ । ১৯৯৮ সালে পি এম এ রে মাধ্যমে মহাকাশ স্টেশন দুটিকে যুক্ত করা হয় । কিন্তু তখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের নভচারীদের বসবাসের উপযোগী ছিল না । এরপর ২০০০ সাল পর্যন্ত একের পর এক এই স্টেশন উন্নয়নের কাজ চলতে থাকে । পরবর্তীতে ২০০০ সালের নভেম্বরের পর থেকে মহাকাশচারীরা নিয়মিতভাবে এখানে বসবাস করতে শুরু করে । এরপর থেকে এখনো পর্যন্ত মহাকাশ স্টেশন কখনো জনো শূণ হয়নি । সার্বক্ষণিক ভাবে ৬ জন নভোচারী মহাকাশ স্টেশনে অবস্থান করে ।

আরও পড়ুন: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মহাকাশ স্টেশনের ভবিষ্যত কি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে?


What a space station
নভোচারীদের কাজ

আরও পড়ুন: চীনের মহাকাশ স্টেশন

নভোচারীদের প্রধান উদ্দেশ্য

তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো এমন সব বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণা করা যা শুধুমাত্র মহাশূন্যে করা সম্ভব । আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের সাধারণত প্রত্যেক নভচারী অবস্থানের সময় হল ছয় মাস । কিন্তু কোন কোন আই এস এসে কর্মীকে প্রায় বছর খানেক এখানে থাকতে হয় । দীর্ঘ সময় পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে মানব শরীরে কি কি ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে তাদের উপর সেসব পরীক্ষা করা হয় । মহাকাশ স্টেশন টির দৈর্ঘ্য একটি ফুটবল মাঠের চেয়ে ও অনেক বড় । এবং এর ভেতরের পরিসর ৬ বেড রুমের একটি বাসার সমান ।

মহাকাশ স্টেশন যেদেশ গুলোকে নিয়ে গঠিত

বর্তমানে ১৫টি দেশ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে তাদের গবেষণা ও কার্যক্রম পরিচালনা করে । এখানে কাজ করা দেশগুলো হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়া, জাপান এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির অধীনে থাকা ১১টি দেশ । ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর হলো যুক্তরাজ্য, জার্মানি,ফ্রান্স,স্পেন,নরওয়ে,সুইডেন,ইতালি, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও ডেনমার্ক । বহুদেশের দক্ষ গবেষকদের অংশগ্রহণের কারণে প্রকৃতপক্ষেই এটি একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণাগার এ পরিণত হয়েছে ।

নভোচারীদের কাজ

তিন দশকের বেশি সময় প্রায় সাড়ে ৩০০ জনের বেশি নভোচারী এই মহাকাশ স্টেশনে কাজ করেছে । অতীতে মহাকাশ স্টেশন থেকে ফিরে আসার সময় দুইটি দুর্ঘটনায় ১৪ জন নভোচারী মারা যায় । এই দুর্ঘটনা আমাদেরকে স্পষ্টভাবে মনে করিয়ে দেয় সকল ধরনের সর্তকতা পূর্ব প্রস্তুতি থাকা সত্বেও প্রতিটি মহাকাশ ভ্রমণে রয়েছে সম্ভাব্য বিপদের ঝুঁকি । আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে করা বিভিন্ন গবেষণা মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানব জাতির ধারণা ও জ্ঞানকে এক অনন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভবিষ্যতে মহাশূন্যের আরো গভীরে অভিযান পরিচালনার জন্য মানুষ যে সমস্ত অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে । এখানে অবস্থানরত বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে এসব সমস্যা সমাধানে কাজ করে চলেছেন ।

মহাকাশ স্টেশনের গতি

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন প্রতি ঘন্টায় ২৮০০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে । এই গতিতে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করতে আই এস এসে সময় লাগে মাত্র ৯২ মিনিট । মহাকাশ স্টেশন তুলনামূলক পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে প্রদক্ষিণ করে । ঘুরতে ঘুরতে এক সময় আই এস এসে পৃথিবীর আরও কাছাকাছি চলে আসে । যদি কোন ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে এটি প্রচন্ড গতিতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করবে । আর সাথে সাথে এর বাইরের আবরণের সৃষ্টি হবে ভয়াবহ অগ্রিনিকান্ড । এ ধরনের মারাত্মক দুর্ঘটনা রোধ করতে নির্দিষ্ট সময় পরপর বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্যে স্টেশনকে ঠেলে উপরের দিকে পাঠানো হয় । যাতে করে স্টেশন তার নিজস্ব কক্ষপথের প্রদক্ষিণ করতে পারেন । মানুষের এই মহাকাশ বিজয় নিঃসন্দেহে মানব সভ্যতার এক অবিস্মরণীয় অর্জন ।

তবে এই অর্জনের সূত্রপাত হয়েছিল উড়োজাহাজ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে । উড়োজাহাজ আবিষ্কারের ইতিহাস মূলত তিব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার গল্প ।এই দ্বন্দ্বের এক প্রান্তে ছিলেন উড়োজাহাজ আবিষ্কারের পথিকৃৎ উইলবার রাইট ও তার ভাই অলভির রাইট । এবং অপর প্রান্তে ছিলেন জেম কাটিস নামের একজন মোটরসাইকেল নির্মাতা । বিজ্ঞান ও যন্ত্রপ্রকৌশল এই মহারথীদের দ্বন্দ্বের ফলে কিভাবে উড়োজাহাজ আবিষ্কার হয়েছিল । সে সম্পর্কে জানতে চাইলে আমাদের পোষ্ট গুলতে দেখুন ।এই পোষ্টটি ভালো লাগলে লাইক করুন বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন । 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url